বাণিজ্যিক ব্যাংকের কার্যাবলি|Functions of Commercial Bank

বিভিন্ন হিসাবের মাধ্যমে আমানতের অর্থ সংগ্রহ করে তহবিল গঠন করাই বাণিজ্যিক ব্যাংকের প্রধান কার্যাবলি। তবে আধুনিক যুগে ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্প্রসারণ ঘটার পাশাপাশি এর প্রতিযোগিতার পরিমাণ ও বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই বাণিজ্যিক ব্যাংকের আমানত গ্রহণ এবং ঋণদানের মাধ্যমে কার্যক্রম শুরু হলেও, বর্তমানে গ্রাহকের বিভিন্নমুখী চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে কাজের পরিধি বৃদ্ধি পাচ্ছে। এবং নতুন নতুন বৈচিত্র্যময় ব্যবহারও যুক্ত হচ্ছে। বাণিজ্যিক ব্যাংক সাধারণত গ্রাহকদের প্রয়োজন অনুযায়ী সেবা প্রদান করার জন্য বিভিন্ন কার্যাবলি সম্পাদন করে থাকে। এবং ঋণের মাধ্যমে আমানত ও আমানতের মাধ্যমে ঋণ সৃষ্টি করে। আর এই উভয়বিদ কার্যক্রমের সমন্বয় দেশের অর্থনৈতিক উন্নতিকে ত্বরান্বিত করে। নিচে বাণিজ্যিক ব্যাংকের কার্যাবলি আলোচনা করা হলো:

বাণিজ্যিক ব্যাংকের সাধারণ কার্যাবলি|Primary functions of Commercial Bank


১. আমানত গ্ৰহণ (Accepting deposit): বাণিজ্যিক ব্যাংকের সর্বপ্রধান কাজই হচ্ছে জনসাধারণের উদ্বৃত্ত নগদ অর্থ আমানত হিসেবে সংগ্রহ করা। সংগৃহীত আমানতই ব্যাংক তহবিলের প্রধান উৎস। কোনো বাণিজ্যিক ব্যাংকের সাফল্য অনেকাংশে আমানত সংগ্রহের সামর্থ্যের ওপর নির্ভরশীল। এজন্য বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহ আমানত সংগ্রহের পরিমাণ বৃদ্ধিতে তৎপর থাকে। বাণিজ্যিক ব্যাংক প্রধানত নিম্নোক্ত তিন ধরনের হিসাবের মাধ্যমে আমানত সংগ্রহ করে:

i. চলতি হিসাব।
ii. সঞ্চয়ী হিসাব ও
iii. স্থায়ী আমানত হিসাব।

২. ঋণদান (Granting loan): বাণিজ্যিক ব্যাংক আমানত হিসেবে সংগৃহীত অর্থ অলস রাখে না। সংগৃহীত আমানতকে সে বিভিন্ন ধরনের ঋণ পণ্যে পরিণত করে এবং বিভিন্ন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানে তা বিতরণ করে। ঋণের সুদই বাণিজ্যিক ব্যাংকের আয়ের প্রধান উৎস। বাণিজ্যিক ব্যাংক জমাতিরিক্ত ঋণ, নগদ ঋণ ও বিল বাট্টাকরণ, ভোক্তা ঋণ ও মেয়াদি ঋণ প্রদান করে।

৩. ঋণ আমানত সৃষ্টি (Creation of credit deposit): বাণিজ্যিক ব্যাংকের একটি বিশেষ কাজ হচ্ছে ঋণ আমানত সৃষ্টি। কোনো ব্যাংক যখন কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে ঋণদান করে তখন তাকে সরাসরি নগদ অর্থ প্রদান করে না বরং বিশেষ এক ধরনের ব্যাংক হিসাবে উক্ত ঋণের অর্থ স্থানান্তর করে। অর্থাৎ, ঋণ গ্রহীতার ঋণ হিসাবে তা ক্রেডিট করে। ঋণগ্রহীতা পরবর্তীকালে চেকের মাধ্যমে মঞ্জুরিকৃত ঋণের অর্থ সংগ্রহ করে। এক্ষেত্রে ব্যাংক নতুনভাবে কোনো নগদ অর্থ গ্রহণ না করেই আমানতের পরিমাণ বৃদ্ধি করে এবং তা হতে আবার ঋণদান করে। এজন্য Sayers বলেন,
ব্যাংক শুধুমাত্র অর্থের সরবরাহকারী নয় বরং একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক দিয়ে অর্থের উৎপাদকও।

৪. বিনিময় মাধ্যম সম্প্রসারণ (Promotion of medium of exchange): বাণিজ্যিক ব্যাংক তুলনামূলক কম ব্যয়সাপেক্ষে বিনিময় মাধ্যম সৃষ্টি করে। চেক, ব্যাংক ড্রাফট, পে-অর্ডার প্রভৃতি ব্যাংক সৃষ্ট সহজ এবং নিরাপদ বিনিময় মাধ্যম।

৫. অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্য অর্থায়ন (Financing domestic & foreign trade): বাণিজ্যিক ব্যাংক অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বিনিময় বিল বাট্টাকরণ, স্বল্পমেয়াদি ঋণ মঞ্জুর, প্রত্যয়পত্র ইস্যু, ব্যাংকের স্বীকৃতিপত্র ইস্যু প্রভৃতির মাধ্যমে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অর্থায়ন সুবিধা প্রদান করে।

৬. তহবিল স্থানান্তর (Transfer of funds): বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহ দেশ-বিদেশের ছড়ানো-ছিটানো শাখার মাধ্যমে দেশের অভ্যন্তরে ও বিদেশ হতে অতি দ্রুত অর্থ প্রেরণ করতে পারে। ব্যাংক ড্রাফট, পে-অর্ডার, অনলাইন ও অন্যান্য মাধ্যমে নামেনার কমিশল্পে বিনিময়ে বাণিজ্যিক ব্যাংক এ ধরনের সেবা প্রদান করে। একইভাবে ব্যাংক বিদেশেও অর্থ প্রেরণে সহায়তা করে।

৭. বিল বাট্টাকরণ (Bill Discounting): বিনিময় বিলের মাধ্যমে ক্রয়-বিক্রয় নিষ্পত্তি করা অন্যতম জনপ্রিয় মাধ্যম। এতে একজন বিক্রেতা তার আর্থিক সংকটের সময় ব্যাংক মেয়াদপূর্তির পূর্বেই তার বিলের বাট্টাকরণ করে নগদ অর্থ সংগ্রহ করতে পারে। ফলে বিক্রেতার আর্থিক সংকট দূরীভূত হয়। আর ব্যাংকেরও বাট্টার মাধ্যমে কিছু আয় হয়।

প্রতিনিধি হিসেবে সম্পাদিত বাণিজ্যিক ব্যাংকের কার্যাবলি| Commercial bank functions performed as a representative



বাণিজ্যিক ব্যাংক বিভিন্ন আর্থিক বিষয়ে গ্রাহকের প্রতিনিধি হিসেবে ভূমিকা পালন করে। গ্রাহকের প্রতিনিধি হিসেবে বাণিজ্যিক ব্যাংক নিম্নোক্ত কার্যাবলি সম্পাদন করে:

১. পাওনা আদায় ও দেনা পরিশোধ (Collection of receivables & payment of payables): বাণিজ্যিক ব্যাংক প্রতিনিধি হিসেবে গ্রাহকের পক্ষে বিভিন্ন আর্থিক হাতিয়ার যেমন- চেক, বিল, প্রতিজ্ঞাপত্র প্রভৃতির অর্থ আদায় ও পরিশোধ করে।

২. সিকিউরিটিজ ক্রয়-বিক্রয় (Purchase & sale of securities): বাণিজ্যিক ব্যাংক গ্রাহকের প্রতিনিধি হিসেবে শেয়ার, বন্ড, ঋণপত্র, অগ্রাধিকার শেয়ার প্রভৃতি আর্থিক সম্পদ ক্রয়-বিক্রয় করে। বাণিজ্যিক ব্যাংক গ্রাহকের নির্দেশ মোতাবেক আর্থিক সম্পদ ক্রয়-বিক্রয় করে। অনেক ক্ষেত্রে ব্যাংক এ ধরনের আর্থিক সম্পদ ক্রয়-বিক্রয়ের বিষয়ে গ্রাহককে পরামর্শও প্রদান করে।

৩. গ্রাহকের প্রতিনিধিত্ব (Functions as correspondent): বাণিজ্যিক ব্যাংক গ্রাহকের প্রতিনিধি ও সহযোগী হিসেবে বিভিন্ন ভূমিকা পালন করে। পাসপোর্ট সংগ্রহ, বিমান, জাহাজ প্রভৃতি যানবাহনের টিকিট সংগ্রহও করে থাকে।

৪. আয়কর উপদেষ্টা (Income tax consultancy): আয়কর বিশেষজ্ঞ হিসেবে বাণিজ্যিক ব্যাংক গ্রাহকের আয়কর রিটার্ন প্রকৃত করে।

৫. স্থির নির্দেশনা পালন (Execution of standing orders): বাণিজ্যিক ব্যাংক গ্রাহকদের নির্দিষ্ট সময়ের জন্য স্থিরকৃত নির্দেশনা পালন করে। ব্যাকে নির্দিষ্ট মেয়াদ পর পর আয়কর, ভাড়া, সুদ, বিমা প্রিমিয়াম পরিশোধ করে। এ ধরনের নৈমিত্তিক কাজ সম্পাদনের জন্য বাণিজ্যিক ব্যাংককে গ্রাহকের বারবার নির্দেশনা দিতে হয় না। একবার নির্দেশনা দিলেই বাণিজ্যিক ব্যাংক নিয়মিতভাবে এ ধরনের নির্দেশনা পালন করে।
বাণিজ্যিক ব্যাংকের কার্যাবলি
৬. অছি ও সম্পাদনকারীর ভূমিকা পালন (Functions as trustee & executor): বাণিজ্যিক ব্যাংক উইলকৃত সম্পত্তির উইল কর মত্যার পরে উক্ত সম্পত্তি হস্তরে সহায়তা করে।

৭. কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিনিধিত্ব (Representative of Central Bank): বাণিজ্যিক ব্যাংক ঋণ নিয়ন্ত্রণ, মুদ্রাবাজার প্রচলনসহ অনেক নতুন মুদ্রা প্রচলনে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিনিধি হিসেবে সাহায্য করে।

৮. গোপনীয়তা রক্ষা (Maintain Secrecy): গ্রাহকের নিরাপত্তার স্বার্থে গ্রাহক ব্যতীত অন্য কোনো ব্যক্তির নিকট তার বা গ্রাহকের হিসাব সংক্রান্ত কোনো তথ্য প্রকাশ করে না। গোপনীয়তা রক্ষা করা যেকোনো সাধারণ ব্যাংকের অত্যাবশ্যকীয় দায়িত্ব।

সাধারণ সেবাসমূহ প্রদান|Functions as general utility service provider


আধুনিক ব্যাংকিং ব্যবস্থায় বাণিজ্যিক ব্যাংক গ্রাহকের প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি কিছু সাধারণ সেবাও প্রদান করে। যেমন

১. প্রত্যয়পত্র ইস্যু (Issuance of Letter of credit): বাণিজ্যিক ব্যাংক ধারে ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে বিশেষত, বৈদেশিক বাণিজ্যে বিক্রেতাকে  রপ্তানিকারক) গ্রাহকের (আমদানিকারক) পক্ষে মূল্য পরিশোধের নিশ্চয়তা প্রদান করে। এতে দেশীয় এবং বৈদেশিক বাণিজ্য সম্প্রসারিত হয়।

২. অবলেখন (Under writing): বাণিজ্যিক ব্যাংক অবলেখকের দায়িত্ব পালন করে। অবলেখক হিসেবে বাণিজ্যিক ব্যাংক শেয়ার, ঋণপত্র, বন্ড, অগ্রাধিকার শেয়ার প্রভৃতি আর্থিক সম্পদ ইস্যুর মাধ্যমে ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানসমূহকে সহায়তা করে। এক্ষেত্রে বাণিজ্যিক ব্যাংক আর্থিক সম্পদের পরিমাণ ও মূল্য নির্ধারণ করে, বিক্রয় পদ্ধতি নির্ধারণ করে এবং অন্যান্য ঝুঁকি বহন করে। ব্যাংকসমূহ বাণিজ্যিক কোম্পানি, সরকার এবং মিউনিসিপ্যাল কর্তৃপক্ষকে এ ধরনের সেবা প্রদান করে।

৩. ট্রাভেলার্স চেক ইস্যু ও ক্রেডিট কার্ড সুবিধা প্রদান (Providing the facilities of travellers cheque and credit card): বাণিজ্যিক ব্যাংক ট্রাভেলার্স চেক ইস্যু করে ভ্রমণকারীদের দেশ-বিদেশে ভ্রমণে সহায়তা প্রদান করে। তাছাড়া ক্রেডিট কার্ড ইস্যুর মাধ্যমে ব্যাংক গ্রাহকদের ধারে পণ্য দ্রব্যাদি ক্রয় করতে সহায়তা করে।

৪. উপহার চেক (Gift cheque): বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ও উৎসবে উপহার প্রদানের জন্য বাণিজ্যিক ব্যাংক উপহার চেক ইস্যু করে।

৫. বিলে স্বীকৃতি প্রদান (Accepting bill of exchange): বাণিজ্যিক ব্যাংক গ্রাহকের পক্ষে বিলে স্বীকৃতি প্রদান করে। বিলে স্বীকৃতি প্রদানের মাধ্যমে ব্যাংক গ্রাহককে ধারে পণ্য ক্রয় ও বিদেশ হতে পণ্য আমদানিতে সহায়তা প্রদান করে।

৬. মার্চেন্ট ব্যাংকের সুবিধা প্রদান (Providing services as a merchant bank): বর্তমান সময়ে অনেক ক্ষেত্রে বাণিজ্যিক ব্যাংকের আলাদা মার্চেন্ট ব্যাংকিং বিভাগ থাকে। যার মাধ্যমে বাণিজ্যিক ব্যাংক মার্চেন্ট (শেয়ার ও ঋণপত্র ইস্যু ও অবলেখনা) ব্যাংকের সুবিধা প্রদান করে। 

৭. মধ্যস্থতাকারী হিসেবে (Acting as a referee): 
বাণিজ্যিক ব্যাংক সর্বত্রই একটি সুপরিচিত ও সুনাম সম্পন্ন প্রতিষ্ঠান। বাণিজ্যিক ব্যাংক তার এই সুনাম ব্যবহার করে অনেক সময় দেনাদার ও পাওনাদারের মধ্যস্থতাকারী হিসেবে অবদান রাখে।

৮. লকার সুবিধা প্রদান (Providing locker facility): বাণিজ্যিক ব্যাংক গ্রাহকদের মূল্যবান সম্পদ যেমন— স্বর্ণ, রৌপ্য, অলংকার এবং দলিলপত্রাদি সংরক্ষণের জন্য লকার সুবিধা প্রদান করে।

আর্থসামাজিক দায়িত্ব পালনে বাণিজ্যি ব্যাংকের কার্যাবলী| Commercial Bank functions in fulfilling socio-economic responsibilities

বর্তমান সময়ে বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহ বিশেষত, উন্নয়নশীল দেশসমূহের বাণিজ্যিক ব্যাংক সরকারের নির্দেশনা মোতাবেক আর্থসামাজিক উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করে। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকসমূহ আরও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।

আর্থসামাজিক উন্নয়নের অংশীদার হিসেবে বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহ কৃষকদের ক্ষুদ্রঋণ সরবরাহ; ক্ষুদ্র গ্রামভিত্তিক শিল্প ও ব্যবসায়ে ঋণদান; শিক্ষাবৃত্তি প্রদান; ক্ষুদ্র ক নৃগোষ্ঠী, দর্জি, মুচি, রিকশাচালক বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষকে ঋণদান প্রভৃতি বাণিজ্যিক ব্যাংক কর্তৃক পালনীয় সামাজিক দায়িত্বের উদাহরণ।

উপরিউক্ত আলোচনা থেকে বলা যায়, বর্তমানে বাণিজ্যিক ব্যাংককে অর্থনীতির মধ্যমণি বলা হয়। বর্তমানে অর্থনৈতিক ও ব্যবসা বাণিজ্যের উন্নয়নের ফলে আর্থিক লেনদেনের চাহিদা ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই যেকোনো দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বাণিজ্যিক ব্যাংকের গুরুত্ব অপরিসীম।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url