উত্তম পরিকল্পনার বৈশিষ্ট্য

পরিকল্পনা হলো ভবিষ্যৎ কাজের অগ্রিম নকশা। পরিকল্পনার ওপর প্রতিষ্ঠানের সফলতা নির্ভর করে। প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য মানসম্মত পরিকল্পনার বিকল্প নেই। তাই, প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের জন্য উত্তম পরিকল্পনা তৈরি করা জরুরি। নিচে উত্তম পরিকল্পনার বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা হলো-
Top 15 Characteristics of a Good Planning
১. নির্দিষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য (Specific goal and objective): প্রতিষ্ঠানের এক বা একাধিক লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য থাকতে পারে। তবে, পরিকল্পনা প্রণয়নের আগে এর উদ্দেশ্য সুনির্দিষ্ট করে নিতে হয়। উদ্দেশ্যবিহীন কোনো পরিকল্পনা প্রতিষ্ঠানের জন্য ফলপ্রসূ হয় না। তাই, সুস্পষ্ট উদ্দেশ্য সম্বলিত পরিকল্পনাকে আদর্শ বা উত্তম পরিকল্পনা বলা হয়।

২. ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা (Future guideline): প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করে পূর্বানুমানের ভিত্তিতে পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হয়। ভবিষ্যৎ কর্মসূচির সুস্পষ্ট নকশা বা রূপরেখা হলো পরিকল্পনা। তাই Allen বলেছেন,
পরিকল্পনা হলো ভবিষ্যতকে ধরার একটি ফাঁদ। এজন্য পরিকল্পনা এমন হতে হবে যাতে এর মাধ্যমে ভবিষ্যৎ কর্মপন্থার সঠিক দিকনির্দেশনা পাওয়া যায়।

৩. নিরবচ্ছিন্নতা (Continuity): কাজের ধারাবাহিকতা রক্ষা করা পরিকল্পনার একটি বিশেষ গুণ। পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ শুরু হলে তা যেন নিরবচ্ছিন্নভাবে চলতে থাকে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। এজন্য একটি কাজ বা পরিকল্পনা। শেষ হওয়ার আগেই পরবর্তী পরিকল্পনা প্রস্তুত রাখতে হবে।

৪. পূর্বানুমান (Forecasting): ভবিষ্যৎ পরিস্থিতি সম্পর্কে অনুমান বা ধারণাই হলো পূর্বানুমান। এটি নির্ভর করে। উপাত্ত ও তথ্য, অভিজ্ঞতা, গবেষণা, শিক্ষা, বর্তমান পরিস্থিতি প্রভৃতির ওপর। কোনো কাজের সঠিকভাবে পূর্বানুমান। করে ভবিষ্যৎ ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তা দূর করার চেষ্টা করা হয়।

৫. মিতব্যয়িতা (Economy): পরিকল্পনা প্রণয়নে ব্যয় কমানোর দিকে খেয়াল রাখতে হবে। এছাড়া এমনভাবে পরিকল্পনা তৈরি করা উচিত, যাতে যথাসম্ভব অল্প খরচে কাজ করা যায়। এর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠান লাভজনকভাবে উন্নতির পথে এগিয়ে যেতে পারে।

৬. সহজবোধ্যতা (Easily understandable): পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানের সব কাজ সম্পাদিত হয়ে থাকে। উপরের স্তরের কর্মকর্তারা পরিকল্পনা প্রণয়ন করেন। নিচের স্তরের কর্মীরা পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেন। তাই, এটি এমনভাবে প্রণয়ন করতে হয় যাতে সবাই বুঝতে পারে। এর বিবরণ বিশদ ও সহজ না হলে কর্মীরা এটিকে সহজভাবে নেয় না। ফলে ভুল-বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয় এবং কাজ সম্পাদনে বাধা তৈরি হয়।

৭. নমনীয়তা (Flexibility): ভবিষ্যৎ সর্বদাই অনিশ্চিত ও পরিবর্তনশীল। যেকোনো পরিস্থিতির কারণে পরিকল্পনায় পরিবর্তন আনার প্রয়োজন হতে পারে। তাই এটি এমনভাবে প্রণয়ন করা উচিত যাতে প্রয়োজনে পরিবর্তন বা পরিস্থিতির সাথে সামঞ্জস্য বিধান করা যায়।

৮. বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগ (Applying thoughtfulness): Koontz and O'Donnell এর মতে, পরিকল্পনা একটি বুদ্ধিদীপ্ত প্রক্রিয়া। এর মাধ্যমে ভবিষ্যতে করণীয় কালের আগাম নকশা তৈরি করা হয়। এই নকশায় প্রতিষ্ঠানের ভবিষ্যৎ কাজের সমাধান প্রতিফলিত হয়। তাই প্রতিষ্ঠানকে যৌক্তিক চিন্তা-ভাবনা, দূরদৃষ্টি, বুদ্ধিমত্তা ও কল্পনাশক্তি দিয়ে পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হয়।

৯. সৃজনশীলতা (Creativity): গবেষণার মাধ্যমে নিত্যনতুন পদ্ধতি আবিষ্কার ও কৌশল প্রয়োগ করা হলো সৃজনশীলতা। ব্যবসায় পরিকল্পনা সৃজনধর্মী হওয়া প্রয়োজন। উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য ভবিষ্যতের বিভিন্ন অবস্থার সাথে পরিকল্পনাকে খাপ খাওয়ানোর প্রয়োজন দেখা দিতে পারে। সুতরাং, পরিকল্পনা সৃজনশীল না হলে তা ছন্দ ও গতি হারিয়ে ফেলতে পারে।

১০. সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার (Proper utilization of resources): প্রতিষ্ঠানের সম্পদ সব সময় সীমিত থাকে। তাই, সীমিত সম্পদের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা উত্তম বা আদর্শ পরিকল্পনার একটি বিশেষ গুণ। সম্পদের অপচয় হলে মুনাফা কমে যায় ও প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই, পরিকল্পনা প্রণয়নে এ বিষয়ে সচেতন থাকতে হয়।

১১. বাস্তবমুখী (Realistic): উত্তম বা আদর্শ পরিকল্পনা সব সময় বাস্তবমুখী হয়ে থাকে। অবাস্তব ধ্যান-ধারণা নিয়ে পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হলে তা কখনো সাফল্য বয়ে আনে না। এছাড়া, অনুমাননির্ভর পরিকল্পনার ফলে প্রাতিষ্ঠানিক সম্পদের অপচয় ও সমস্যা তৈরি হয়। তাই, পরিকল্পনাকে সব সময় বাস্তবমুখী হতে হবে।

১২. গ্রহণযোগ্যতা (Acceptability): পরিকল্পনা প্রতিষ্ঠানের উপর থেকে নিচের স্তর পর্যন্ত সব কর্মীর কাছে গ্রহণযোগ্য হতে হবে। কর্মীরা পরিকল্পনাকে আন্তরিকতার সাথে না নিলে তা যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয় না। ফলে, প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য অর্জনও সম্ভব হয় না। তাই বর্তমানে অংশগ্রহণমূলক ব্যবস্থাপনার ওপর জোর দেওয়া হয়। এতে পরিকল্পনা প্রণয়নে অধীনস্থদের মতামত নেওয়া হয়।

১৩. তথ্যনির্ভর (Information based): তথ্যনির্ভর পরিকল্পনা প্রতিষ্ঠানের জন্য সুফল বয়ে আনে। কল্পনা বা অনুমানের উপর ভিত্তি করে পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হলে, তা উত্তম পরিকল্পনা হয় না। এ ধরনের পরিকল্পনা কাজের ক্ষেত্রে সফলতা আনতে পারে না। তাই, পরিকল্পনা প্রণয়নে সব সময় সঠিক উপাত্ত ও তথ্য ব্যবহারে সচেষ্ট হতে হবে।

১৪. সমন্বয়সাধন (Coordination): পরিকল্পনা প্রণয়নের সময় সংশ্লিষ্ট সব বিভাগের মধ্যে সমন্বয় ও যোগসূত্র রক্ষা করা উচিত। বিভাগীয় ব্যবস্থাপকরা তাদের পরিকল্পনার মধ্যে সমন্বয় না করলে প্রাতিষ্ঠানিক উদ্দেশ্য অর্জন সম্ভব হয় না। ফলে প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন রকম জটিলতা দেখা দেয়।

১৫. সামগ্রস্যতা (Balancing): প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে মূল পরিকল্পনার অধীনে ছোট বা খণ্ড পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হয়। আবার, প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য অর্জনের ক্ষেত্রে কাজকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়। প্রতিটি কাজ সঠিকভাবে সম্পাদনের জন্য আলাদা পরিকল্পনাও প্রণয়ন করা হয়। তাই, প্রতিটি কাজ ও পরিকল্পনায় যাতে মিল থাকে, সেদিকে খেয়াল রেখে পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হয়। এতে কাজের সামঞ্জস্যতা বজায় থাকে।

অতএব বলা যায়, সঠিক পরিকল্পনা ছাড়া প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্যে পৌঁছানো প্রায় অসম্ভব। তাই, একটি আদর্শ বা উত্তম পরিকল্পনায় উপরিউক্ত বৈশিষ্ট্যগুলো বিদ্যমান থাকা উচিত। অন্যথায়, প্রণীত পরিকল্পনা সফল হবে না। এজন্য পরিকল্পনা প্রণয়নকারীকে নির্দিষ্ট ব্যাপারে সব সময় খেয়াল রাখতে হবে।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url