ব্যাংক তহবিলের ধারণা |Concept of Bank Fund

ব্যবসায়ের জন্য মালিক যে পুঁজি বিনিয়োগ করে সেটাই তার তহবিল। ব্যবসায়ের জন্য মালিক নিজস্ব উৎস ছাড়াও অন্য উৎস থেকে ঋণ বা অন্য কোনোভাবে যে অর্থ সংগ্রহ করে সেটাও ব্যবসায় তহবিলের অন্তর্ভুক্ত।

ব্যবসায়িক প্রয়োজনে নিজস্ব ও বাইরের বিভিন্ন উৎস থেকে ব্যাংক যে অর্থ সংগ্রহ করে তার সমষ্টিকে ব্যাংক তহবিল বলে। ব্যাংক একটি আর্থিক মধ্যস্থ ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান। তাই অর্থই হলো এরূপ ব্যবসায়ের প্রধান উপকরণ। এরূপ অর্থ সংগ্রহের জন্য ব্যাংক নিজস্ব উৎসের বাইরেও বিভিন্ন উৎস থেকে অর্থ সংগ্রহের চেষ্টা চালায়। নিজস্ব ও বিভিন্ন উৎস থেকে সংগৃহীত এরূপ অর্থকেই ব্যাংকের বা ব্যাংকারের তহবিল নামে আখ্যায়িত করা হয়।
ব্যাংক তহবিল কি
সাধারণভাবে নিজস্ব উৎস বলতে ব্যাংকের শেয়ার বিক্রয়লব্ধ অর্থকে বুঝায়। এছাড়াও ব্যাংক যে মুনাফা অর্জন করে তার সবটা শেয়ারহোল্ডারদের মধ্যে বণ্টন না করে তা থেকে সঞ্চিতি তহবিল গড়ে তোলে। এই সঞ্চিতি তহবিলে জমাকৃত অর্থ নিজস্ব উৎসের একটা গুরুত্বপূর্ণ উৎস।

অন্যদিকে চলতি, সঞ্চয়ী ও স্থায়ী হিসাবে ব্যাংক যে আমানত সংগ্রহ করে তাও ব্যাংকের তহবিলের প্রধান উৎস হিসেবে গণ্য হয়। এছাড়াও ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা অন্যান্য ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়। এই প্রধান তিনটি উৎসের সমন্বয়েই ব্যাংকের তহবিল গড়ে ওঠে। যা বিভিন্ন ক্ষেত্রে ঋণদান ও বিনিয়োগ করে ব্যাংক মুনাফা অর্জন করে। অর্থাৎ ব্যাংকের তহবিল = শেয়ার মূলধন + সঞ্চিতি তহবিল + আমানত হিসাবে সংগৃহীত অর্থ + কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও অন্যান্য উৎস থেকে সংগৃহীত ঋণ।

ব্যাংকের স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি তহবিলের উৎস| Various Sources of Bank's Short Term & Long Term Fund


বিশেষ ধরনের ব্যাংক বাদ দিলে সকল বাণিজ্যিক ব্যাংক স্বল্পমেয়াদি ঋণের ব্যবসায়ী। নিজস্ব মূলধনের বাইরে এর অধিকাংশই আমানতকারীদের চাহিদা আমানত। যা ব্যাংককে চাহিবামাত্র ফেরৎ দিতে হয়। এর বাইরে কিছু বিশেষ আমানত হিসাব এবং স্থায়ী হিসাব থাকে যেখানে থেকে ব্যাংক দীর্ঘমেয়াদি তহবিল জোগাড় করতে পারে।

১. পরিশোধিত মূলধন (Paid-up capital): ব্যাংক তার শেয়ার বিক্রয় করে যে মূলধন সংগ্রহ করে তাকেই পরিশোধিত মূলধন বলে। বর্তমানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তালিকাভুক্তির ক্ষেত্রে কোনো ব্যাংকের কমপক্ষে ৪০০ কোটি টাকা পরিশোধিত মূলধন থাকতে হয়। এটি ব্যাংকের নিজস্ব মূলধনের প্রথম ও প্রধান উৎস।

২. সঞ্চিতি তহবিল (Reserve fund): ব্যাংক তার অর্জিত মুনাফা থেকে প্রয়োজন অনুযায়ী বিভিন্ন সঞ্চিতি তহবিল গড়ে তোলে। এরূপ তহবিল ব্যাংকের নিজস্ব মূলধন সংগ্রহের আরেকটি অন্যতম উৎস। এরূপ তহবিলের উৎসসমূহ নিম্নরূপ:

i. বিধিবদ্ধ রিজার্ভ (Statutory reserve): এরূপ তহবিল সংস্থান তালিকাভুক্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকের জন্য বাধ্যতামূলক। আইনানুযায়ী এরূপ তহবিল ব্যাংকের শেয়ার মূলধনের সমান না হওয়া পর্যন্ত অর্জিত মুনাফা থেকে প্রতি বছর কমপক্ষে ২০% হারে মুনাফা ব্যাংকের এরূপ তহবিলে স্থানান্তর করতে হয়।

ii. সাধারণ রিজার্ভ (General reserve): ব্যাংক তার অর্জিত মুনাফার অংশবিশেষ কর্তন করে সাধারণ রিজার্ভ ফান্ড গড়ে তুলতে পারে। এরূপ তহবিলে জমাকৃত অর্থের পরিমাণ বেশি হলে ব্যাংক তা থেকে শেয়ার মালিকদের স্টক ডিভিডেন্ট বা বোনাস শেয়ার ইস্যু করে।

iii. অন্যান্য সঞ্চিতি তহবিল (Other reserve fund): ব্যাংক উপরোক্ত রিজার্ভের বাইরেও লভ্যাংশ সমতাকরণ তহবিল, অদাবিকৃত লভ্যাংশ শেয়ার প্রিমিয়াম ফান্ড ইত্যদি মিলিয়ে অন্যান্য সঞ্চিতি তহবিল গড়ে তোলে। গুপ্ত তহবিল (Sinking fund) ও এ ধরনের সঞ্চিতির আওতায় আসে।

৩. বিশেষ আমানত হিসাব (Special deposit account): বর্তমানকালে ব্যাংকসমূহ বিভিন্ন ধরনের বিশেষ আমানত হিসাব খুলে জনসাধারণের নিকট থেকে দীর্ঘমেয়াদে অর্থ সংগ্রহ করে। যা তহবিল সংগ্রহের দীর্ঘমেয়াদি উৎস হিসেবে গণ্য হয় । এরূপ হিসাবসমূহ নিম্নরূপ:

i. মাসিক সঞ্চয় প্রকল্প (Monthly savings scheme): প্রতি মাসে বাধ্যতামূলক সঞ্চয়ের জন্য এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ সঞ্চয় প্রকল্প। একে ডিপোজিট পেনশন স্কীম (DPS) ও বলা হয়। এই প্রকল্প অনুযায়ী আমানতকারী প্রতি মাসে একটা নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা এরূপ সঞ্চয় প্রকল্পে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত জমা করে। মেয়াদান্তে সুদ বা লাভসহ একটা বড় অঙ্কের টাকা আমানতকারী ফেরৎ পায়। অনেক ব্যাংক এরূপ হিসাবে জমার বিপক্ষে আমানতকারীকে ঋণও প্রদান করে।

ii. মাসিক আয় সুবিধা প্রকল্প (Monthly benifit scheme): যাদের হাতে একবারে বেশ কিছু টাকা আসলেও তা বিনিয়োগ করার বা কাজে লাগানোর সামর্থ্য থাকে না তাদের জন্য এরূপ প্রকল্প খুবই সুবিধাজনক। এক্ষেত্রে এক সাথে নির্দিষ্ট বড় অঙ্কের অর্থ টাকা নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য জমা রাখা হয়। এক্ষেত্রে ব্যাংক পূর্বঘোষিত হারে ঐ নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত প্রতি বাসে অথবা নির্দিষ্ট মেয়াদশেষে আমানতকৃত পুরো অর্থ কোনো সুদ বা লাভ ছাড়া একত্রে আমানতকারীকে ফেরৎ দেয়।

iii. বিশেষ সঞ্চয় প্রকল্প (Special savings scheme): এ ধরনের সঞ্চয় প্রকল্পেও নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য একবারে বড় অঙ্কের টাকা জমা রাখা হয়। ব্যাংকের ঘোষণা অনুযায়ী মেয়াদাত্তে জমাকৃত অর্থের দ্বিগুণ বা তিনগুণ অর্থ প্রদান করা হয়। এরূপ প্রকল্প অনেকটা স্থায়ী বা মেয়াদি হিসাবের অনুরূপ। তবে এক্ষেত্রে সুদের হার তুলনামূলকভাবে বেশি হয়। ব্যাংক ক্ষেত্রবিশেষে তার দীর্ঘমেয়াদি আমানত বৃদ্ধির জন্য উৎসাহব্যঞ্জক এরূপ সঞ্চয় প্রকল্পে অর্থ জমার জন্য সুযোগ দিতে পারে।

iv. শিক্ষা সঞ্চয় প্রকল্প (Education savings scheme): এরূপ স্কীমের আওতায় আমানতকারী তার সন্তান বা পোষ্যদের ভবিষ্যৎ লেখাপড়ার খরচ নির্বাহের জন্য অর্থ জমা করে। স্বল্প আয়ের লোকদের পক্ষে অনেক সময় এক পর্যায়ে যেয়ে সন্তান বা পোষ্যদের লেখাপড়ার খরচ চালানো কষ্টকর হয়ে পড়ে। এক্ষেত্রে একজন আমানতকারী নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত মাসিক কিস্তিতে ব্যাংকে অর্থ জমা রাখে। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী মেয়াদ শেষের পর একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত মাসিক কিস্তিতে ব্যাংক আমানতকারী বা তার সন্তান বা পোষ্যদের লেখাপড়ার খরচ নির্বাহের জন্য অর্থ দিয়ে থাকে।

v. হজ্ব প্রকল্প (Hazz scheme): এ প্রকল্পের উদ্দেশ্য হলো হজ্জ করতে ইচ্ছুক এমন ধর্মপ্রাণ লোকদের হজ্বের জন্য অর্থ যোগানোর ব্যবস্থা করা। এরূপ প্রকল্পের আওতায় নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য নির্দিষ্ট মাসিক হারে আমানতকারী হজ্জ একাউন্টে টাকা জমা রাখে। এক্ষেত্রে কত টাকা হজ্বে লাগবে তা একেবারে পূর্ব নির্দিষ্ট না থাকায় আনুমানিক একটা ব্যয় ধরে নিয়ে ঐ পরিমাণ অর্থ মেয়াদ শেষে যাতে হিসাবে লাভ ও আসলে জমা হয় সেভাবে প্রকল্প সাজানো হয়ে থাকে।

vi. গৃহ নির্মাণ বিনিয়োগ আমানত প্রকল্প (Deposits linked to house loan scheme): এরূপ প্রকল্পের আওতায় আমানতকারী নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত নির্দিষ্ট কিস্তি হারে ব্যাংকে অর্থ জমা করে। মেয়াদ শেষে ব্যাংক চুক্তির শর্ত মোতাবেক নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা উক্ত আমানত প্রকল্পে ঋণ দেয়। সুদসহ আমানত ও ঋণ মিলিয়ে যে বড় পরিমাণ অর্থ জমা হয় আমানতকারী তা দিয়ে গৃহ নির্মাণ করে।

৪. ঋণপত্র বা সিকিউরিটিজ বিক্রয় (Sale of debenture or securities): ব্যাংক কোম্পানি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতিক্রমে ডিবেঞ্চার, বন্ড, সিকিউরিটিজ ইত্যাদি বিক্রয় করে দীর্ঘমেয়াদি অর্থসংস্থান করতে পারে। নিম্নে এরূপ কিছু সিকিউরিটিজ বিক্রয়ের দৃষ্টান্ত নিম্নে তুলে ধরা হলোঃ

ক. ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড ইস্যুকৃত ইসলামী ব্যাংক বন্ড।
খ. প্রাইম ব্যাংক লিমিটেডের ১ম মিউচ্যুয়াল ফান্ড।
গ. ট্রাস্ট ব্যাংক লিমিটেডের ১ম মিউচ্যুয়াল ফান্ড।
ঘ. জনতা ব্যাংকের ১ম জনতা ব্যাংক মিউচ্যুয়াল ফান্ড।
ঙ. আই.এফ.আই.সি ব্যাংকের আইএফআইসি ১ম মিউচ্যুয়াল ফান্ড ইত্যাদি।

৫. আমানত হিসাবে সংগৃহীত অর্থ (Accumulated fund from deposit account): ব্যাংক বিশেষত বাণিজ্যিক ব্যাংক বিভিন্ন হিসাবের মাধ্যমে জনগণ ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে আমানত হিসাবে অর্থ সংগ্রহ করে। এক্ষেত্রে চলতি, সঞ্চয়ী ও স্থায়ী হিসাবে সংগৃহীত আমানত উল্লেখযোগ্য। ব্যাংক বিভিন্ন আমানত প্রকল্প খুলে তা থেকেও তহবিল সংগ্রহ করতে পারে।

৬. কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে গৃহীত ঋণ (Loan from central bank): কেন্দ্রীয় ব্যাংক সকল দেশেই তালিকাভুক্ত ব্যাংকসমূহের ঋণের শেষ আশ্রয়স্থল হিসেবে গণ্য হয়। তাই ব্যাংকগুলো প্রয়োজনে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ হিসেবে প্রয়োজনীয় তহবিল সংগ্রহ করে।

৭. মুদ্রাবাজার থেকে গৃহীত ঋণ (Loan from money market): ব্যাংক প্রয়োজনে মুদ্রাবাজারের সদস্য; যেমন - অন্যান্য বাণিজ্যিক ব্যাংক, বিল বাজারের সদস্য ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান থেকেও প্রয়োজনে ঋণ সংগ্রহ করে।

৮. অবন্টিত মুনাফা ও অন্যান্য (Undistributed profit and others): ব্যাংক তার অর্জিত মুনাফার অংশবিশেষ লভ্যাংশ হিসেবে শেয়ারহোল্ডারদের মধ্যে বন্টন করে। এক্ষেত্রে বণ্টিত হয়নি এমন মুনাফা ব্যাংকে থাকলে ব্যাংক তা স্বল্পমেয়াদি তহবিল হিসেবে ব্যবহার করতে পারে। এছাড়া অদাবিকৃত লভ্যাংশ, লাভ-ক্ষতি হিসাবে লাভের জের, বিভিন্ন প্রভিশন ইত্যাদি অনেক সময়ই স্বল্পমেয়াদি অর্থসংস্থানের উৎস হিসেবে গণ্য হয়।

৯. ঋণ ক্ষতি সঞ্চিতি হিসাব (Debt loss provision account): শ্রেণিকৃত ঋণের বেলায় অর্জিত মুনাফা থেকে প্রভিশন বা সঞ্চিতি সৃষ্টি বাধ্যতামূলক। শ্রেণিকৃত বা সম্ভাব্য খেলাপি ঋণ পরিবর্তীতে আদায় হলে তার বিপক্ষে রক্ষিত প্রভিশন মুনাফা হিসেবে ধরা হয়। তাই এরূপ সঞ্চিতি স্বল্পমেয়াদি তহবিলের উৎস হিসেবে কাজ করে।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url