অর্থনৈতিক উন্নয়নে মুদ্রানীতির ভূমিকা

অর্থনৈতিক উন্নয়ন হলো একটি প্রক্রিয়াগত বিষয়, যার মাধ্যমে একটি দেশের জনগণের মাথাপিছু আয় বাড়ে, জীবনযাত্রার মান বাড়ে এবং অর্থনৈতিক কল্যাণ অর্জিত হয়। আর্থিক নীতি ব্যবহার করে যে কোন দেশের সামাজিক কল্যাণ সর্বোচ্চ করা সম্ভব। আর অর্থনৈতিক উন্নয়নের মূল লক্ষ্যই হচ্ছে সামাজিক কল্যাণ সর্বোচ্চ করা। ফলে অর্থনৈতিক উন্নয়নে আর্থিক নীতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।

১. আয় বৃদ্ধি: অর্থনৈতিক উন্নয়নের দিকনির্দেশনা হলো জাতীয় আয়ের বৃদ্ধি। সেক্ষেত্রে আর্থিক নীতি ভূমিকা পালন করে। সামগ্রিক চাহিদা বাড়লে এবং তার সাথে সংগতি রেখে অর্থের যোগান বাড়লে জাতীয় আয় বৃদ্ধি পায়।

২. মুদ্রা বা অর্থ সৃষ্টিকরণ: প্রথমত, অর্থনীতির আর্থিকায়ন এবং প্রকৃত জাতীয় উৎপাদন বৃদ্ধির হেতু চাহিদা মিটানোর স্বার্থে অর্থ সৃষ্টির প্রয়োজন। তবে অর্থ সৃষ্টির হার যেদিকে কাজ করে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। আর্থিক নীতি সেক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। উন্নয়নশীল দেশে অর্থ সৃষ্টির হারকে নিরাপদ সীমায় রাখা সম্ভবপর হয় না। এজন্য মুদ্রাস্ফীতি অনিবার্য দেখা দেয়। সেজন্য আর্থিক নীতি দ্বারা সঞ্চয় ও বিনিয়োগ বৃদ্ধি করতে হলে নতুন অর্থ সৃষ্টিকে অবশ্য নিরাপদ সীমায় রাখতে হবে।

৩. মূল্যস্তরের স্থিতিশীলতা রক্ষা: অর্থনৈতিক উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে মসৃণ পথে এগিয়ে নেয়া তখনই সম্ভব যখন মূল্যস্তর মোটামুটি স্থিতিশীল থাকে। এখানে মূল্যস্তরের স্থিতিশীলতা বলতে সেই অবস্থা বুঝানো হয়, যেখানে অতিরিক্ত মুদ্রাস্ফীতি থাকবে না। তেমনি মুদ্রা সংকোচনও থাকবে না। অর্থাৎ মূল্যস্তরের উঠানামা অর্থনীতিকে যেন বিপর্যস্ত না করে, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। মূল্যস্তর স্থিতিশীল থাকলে সঞ্চয় ও বিনিয়োগ ক্ষেত্রেও স্থিতিশীল থাকে। সেই অনুকূল অর্থনৈতিক পরিবেশ উন্নয়নের সহায়ক হয়।

৪. কাম্য ঋণনীতি অবলম্বন: আর্থিক নীতির অন্যতম অংশ হলো ঋণনীতি। উন্নয়নের লক্ষ্যে অনুৎপাদনশীল খাত থেকে উৎপাদনশীল খাতে স্থানান্তর করতে হয়। এমতাবস্থায় ব্যাংক কর্তৃক ঋণ সরবরাহ বিশেষ ভূমিকা পালন করতে পারে। উৎপাদনশীল খাতের ঋণের সরবরাহ বাড়িয়ে এবং অনুৎপাদনশীল খাতে তা কমিয়ে তার উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে কাম্য স্তরে পরিচালনা করে।

৫. সঞ্চয় ও বিনিয়োগের প্রতিষ্ঠান: এই লক্ষ্যে মুদ্রানীতির সাহায্যে উন্নয়নশীল দেশে বিভিন্ন সময়ে ভাঙানো যায় এমন ধরনের আর্থিক সম্পদ সৃষ্টি করতে হবে যাতে জনগণ তাদের সামর্থ্য ও পছন্দ অনুযায়ী তাতে অর্থ বিনিয়োগ করতে পারে। বিভিন্ন অর্থনীতিবিদ মনে করেন যে, এভাবে আর্থিক সম্পদ সৃষ্টি করে সঞ্চয় বৃদ্ধির মাধ্যমে বিনিয়োগ উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি করা যায়। তাঁরা আরো বলেন যে, সঞ্চয় ও বিনিয়োগ বৃদ্ধির এই প্রয়োগ ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে বিভিন্ন মধ্যবর্তী আর্থিক প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা প্রয়োজন। আর এ দায়িত্ব এসব দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিয়ে থাকে।

৬. বৈদেশিক হারের স্থিতিশীলতা: বাণিজ্যের উপর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নির্ভর করে। বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সাফল্যের প্রয়োজনে বিনিময় হার স্থির রাখতে হবে। তারই ভিত্তিতে আমদানি রপ্তানি বাণিজ্যের প্রসার ঘটতে পারে। তাই আর্থিক নীতির অন্যতম লক্ষ্য হলো বৈদেশিক বিনিময় হারের স্থিতিশীলতা।

৭. সামাজিক ও রাজনৈতিক লক্ষ্য: উন্নয়নশীল দেশ সামাজিক ও রাজনৈতিক দিক থেকে নানা সমস্যায় জর্জরিত। এমতাবস্থায় জনসাধারণের মৌলিক অধিকার নিশ্চিতকরণ এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা দূরকরণার্থে জাতীয় আয়ের সুষম বণ্টনের ক্ষেত্রে আর্থিক নীতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।

উপরের আলোচনা থেকে এ সিদ্ধান্তে আসা যায় যে, আয় বৃদ্ধির ক্ষেত্রে আর্থিক নীতি প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করে। তাই উন্নয়নে আর্থিক নীতির ভূমিকা যথেষ্ট। তাছাড়া উন্নয়ন প্রক্রিয়ার সাথে অর্থের যোগানের সংগতি বিধান করে সঞ্চয়কে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোয় এনে মূল্যস্তর স্থিতিশীল রেখে উন্নয়ন ক্ষেত্রে আর্থিক নীতি ভূমিকা পালন করে।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url